কয়েকজন সাদা মানুষ (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৩)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:০৩:৪৫ রাত
পাটুরিয়া ঘাটে এসে রুনা দেখলো বিশাল সিরিয়াল।
তা প্রায় কয়েক মাইল হবে। আর ওদের বাস যে কোন অবস্থানে আছে, বুঝে উঠতে পারলো না।
বোঝার দরকার ও নাই। ওর তো তাড়া নাই। সুজনের সাথে কিছুক্ষণ আগে ওর কথা হয়েছে। ও এখন কোথায় আছে তা জানতে চাইলো। সে ঘাটের এ পাড়ে আছে জানিয়েছে।
শামুকের গতিতে বাস একটু একটু করে আগাচ্ছে। ফেরিওয়ালাদের চীৎকার ও চেচামেচিতে একটু যে কেউ ঘুমাবে, তারও উপায় নাই।
হ্যান্ড ব্যাগটা বেশ বড়ই রুনার। সবাই আজকাল এ রকম ব্যবহার করে না। তবে রুনার জার্ণিতে এই সাইজের ব্যাগ ছাড়া চলে না। ওর ভিতরে অনেক কিছু থাকে। বই এবং ডায়েরি তার ভিতর অন্যতম।
ডায়েরি লেখার অভ্যাস সেই অনেক আগে থেকেই। গল্পের বই খুব একটা এখন আর পড়ে না। এক সময় বই এর পোকা ছিলো। এ জন্যই তো এখন পাওয়ারের চশমা দিতে হয়েছে চোখে।
ওর ডায়েরিটা বের করে বাসের সীটটাকে আরো একটু বেন্ড করে নিলো। পিছনের যাত্রীকে জানিয়েই অবশ্য। একটু রিল্যাক্স করা প্রয়োজন।
ডায়েরীর ভিতর এমন এক লেখা আছে যেটা যতবার ও পড়ে, ততবার ই ভালো লাগে-কষ্ট পায়-কাঁদে । কিন্তু তারপরও পড়া চাই। এটা এমন এক মিশ্র অনুভুতি যা শুধুমাত্র ও একাই অনুভব করে।
চশমাটাকে নাকের ডগা থেকে আরো একটু সুবিধাজনক যায়গায় অ্যাডজাস্ট করে নিল।
এরপর ডুবে যেতে থাকলো... অতল থেকে অতলে...
বন্ধু সুজন একদিন ওর কাছে দুঃস্বপ্ন কল্পনা করে কিনা জানতে চেয়েছিল। উত্তরে বলেছিল বাস্তবের চেয়ে কল্পনা সব সময় ভালো হয় না । ওর কথার সিম্পল রি-অ্যাকশন ছিল ওই প্রশ্ন।
মানুষ হিসাবে রুনা সহজ ।
কিছু বলতে চাইলে সরাসরি বলতে পারে।
একবার রুনাকে বন্ধুদের মধ্যে একজন বলল " I didn't see u except for a few seconds."
এই ইমোশন হঠাৎ একটা আশ্চর্য অনুভুতির ভিতর ফেলে দিলো ওকে । এটা সুজনকে ব্যাখ্যা করার আগে মনে পড়ল সেই দিনগুলোর কথা। বিবাহিত জীবনে মাসুদের চরম অবহেলার দরুন পুরনো এক বন্ধুর সাথে জেদের বশে কিভাবে যেন পরকিয়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল! বেশ ক' বছর আগে জীবনের সেই চরম অঘটন টা ঘটানোর পর রুনা যেন একেবারে দুনিয়া ছাড়লো । সুইসাইড এর বিকল্প অপরাধবোধের মাত্রাটা এতো বেশি ছিল যে অনুশোচনার মাত্রাটাও সীমার ভিতর থাকলো না। পুরাপুরি ব্যাল্যান্স চলে গেলো প্রথমে । সারাক্ষণ নিজের ভিতরে নিজের সাথে সাথে লেনদেন । মানুষ কেমন গাছ পাতার মতো হয়ে গেলো ওর কাছে।
আগাগোড়া জীবনটা পাল্টে গেলো।
আচার আচরন - চিন্তা , কথা , কাজ , আশা , চেষ্টা সব...।
ওর আশে পাশের সব গুলি সম্পর্ক পাল্টে গেলো ।
সবাই রুনার ব্যবহারে স্বাভাবিকভাবে চরম রিঅ্যাক্ট করলো... পৃথিবীতে একজন একমাত্র প্রানীর মতো বেঁচে রইলো সে । সবই আছে , কিন্তু কিছুই ওর না।
যার জন্য সব ছাড়লো শুধু তাকে নিয়ে বেঁচে রইলো।
যদিও সে ওকে ভুলে গেছে ।কিন্তু রুনা সত্যি সত্যি আর এক মুহূর্তও আড়াল করতে পারেনি ওকে । সব কিছু আশ্চর্য সুন্দর হয়ে গেলো । ও বুঝলো - ভালোবাসার জন্য সত্যি সত্যি কাউকে পেয়েছে , যাকে হারাতে হবে না।
যে ওকে সত্যি সত্যি ভালবাসে... ভালোবাসা আসলে যুদ্ধে যাবার মতো ।
বছরের পর বছর যেতে লাগলো ।
তারপর?
কোনো এক ফ্রেন্ড এর উচ্ছাস রুনাকে এক রকম ধ্যানের ভিতর থেকে বের করে আনল । সে ওর কাছে ফোন নাম্বার চাইল ।
রুনা দিলো ।
তার ফোন রিসিভ করতে গিয়ে দেখে ও নিজের স্বভাবের সব উল্টা কাজ করে যাচ্ছে। একটার পর একটা ভুল করেই যাচ্ছিল। কল বন্ধ করতে গিয়ে আরও খুলে দিলো। ওয়াশিং মেশিনের পানি ডাইনিং স্পেসে চলে আসলো...
রুনা ফোন নিয়ে গেস্ট রুমে দরজা লক করে দিলো ।
সেই বন্ধুর কথা কিছু শুনলো , কিছু শুনলো না । কান গরম হয়ে গেছে ! সারা গা কাঁপতে থাকলো । সে ফোন রাখার পর নিজের অবস্থাটা দেখে হতভম্ব হয়ে বসে রইলো কয়েক ঘণ্টা।
একটা ঘোরের মধ্যে রইলো দিনের পর দিন...
ছেলেদের অ্যাড মিশন ডেট চলে গেল... ঘরে কে আসে কে যায় জানে না । কাজ করে, কিভাবে করে জানে না।
নতুন বিয়ের পরের অবস্থা মনে পড়লো ওর ।
আধা স্বপ্ন আধা সত্য!
ওর গায়ের তাপ পাচ্ছিলো। দিনের পর দিন । অথচ ওর ছবির দিকেও তাকায়নি তখনো।
রুনা এর কিছুই ব্যাখ্যা জানে না।
শুধু ডুবে গেলো একটা নামের ভিতর...
কিছুদিন পর মাথা কাজ করতে শুরু করলো ।
রুনা ওকে বললো , আর ফোন না করতে ।
সে মাইন্ড করলো বোধ হয় ।
তবে ও কিন্তু কিছু জানে না । ওর একেবারে নিজের ভিতরে সব সমস্যা । বন্ধু , তবু কষ্ট দিলো .আহত হয়ে জানতে চাইল , কেন ?
বললো ।
হা হা করে হাসল সে ।
বলল , তুমি পাগল ! লোকে শুনলে হাসবে । বলিও না ।
রুনাও হাসলো । কি করবে ?
এই সময়টাতে মাসুদের সাথে ডিভোর্সের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো । এক বছর আগে থেকে একা ছিলো , একই ঘরে , ভিন্ন রুমে । অনেক সমস্যা ছিল। আর পারছিলো না । ঘটনাক্রমে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাথে যোগাযোগ হল । জানলো , ছোটবেলা থেকে ওর একটা অসুখ আছে , মুডের ।
আবেগ কন্ট্রোল করতে পারে না জানতো । আশ্চর্য হয়ে জানলো এটা একটা অসুখ ! এর মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট আছে !
প্রথম সাজেশন , ফিজিক্যাল প্রয়োজন অবহেলা করা যাবে না । খাওয়া ( প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো ) , হাজব্যান্ড এর সাথে সম্পর্ক - মানসিক , শারীরিক - দুটোই ওকে করতে হবে ।
এর মধ্যে সেই বন্ধুটি বুঝল কিছু । ফোন করে বলল , 'আমি সারা জীবন একজন কে ভালোবেসে এসেছি । সময়ে বলতে পারিনি । পাইনি । আমার বউ , ছেলেকে আমি অনেক ভালবাসি ।' রুনার তখন কথা বলার শক্তি নাই । ওকে বললো , বুঝেছি । ডাক্তারের কথাও বললো। শুধু মনে হচ্ছিলো ভেলার উপর খোলা আকাশের নিচে সমুদ্রে ভাসছে । জীবন , মৃত্যু কিছু ভাবছে না । তবে ওর শত শত সমস্যার কিছুই সমাধান হয়নি । এই অবস্থায় সে হাজব্যান্ড এর বিছানায় ফিরে গেলো ।
ছায়ার মতো বেঁচে রইলো ।
আবার নতুন করে সব গুছালো । ওর অসুখের ব্যাপারটা অনেক বড় একটা ধাক্কা ছিল। তবে সেই বন্ধুটি সারাক্ষণ সাহস দিলো । বলল , পারবে । সাহস কর ।
তারপর ?
সেই বন্ধু ভালো আছে । ওর সংসার , প্রেম , কাজ নিয়ে ব্যস্ত । রুনাও ভালো আছে
আসলেই কি আছে?
আগের মতো আবার গান শুনছে । আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে । অতীত , বর্তমান কোথাও কাউকে বিশেষ কিছু বলার নাই । সময় আছে , বন্ধুদের সাথে নিয়ে দেশের জন্য কাজ করছে । সব ঠিক আছে ।
পৃথিবীতে , অন্য পৃথিবীতে সবুজ বাগানটাতে থাকতে পারলেই হল। এই পৃথিবীতে চাওয়ার আর কিছুই নেই ।
আসলে ভুল গুলিকে ভুল , আর শুদ্ধ গুলিকে শুদ্ধ বলার পর আর সমস্যা থাকে না ।
তার ভিতরে কোনো অন্তর্দাহ? ভিতরে কোথাও জ্বলছে কিনা? জিজ্ঞেস করলো নিজেকে ।
নাহ! সমাধান নাই ... নেই কোনো উত্তর ও...
ওর জীবন নদীর মতো ।
পথে পথে বাঁকে বাঁকে ভিন্ন ইতিহাস , ভিন্ন জীবন ।
সমাধানটা আছে... সমাধান দুরত্ব ... চিরকালের দুরত্ব ...
ভাবনা শেষ করতে পারলো না। মোবাইলের আওয়াজে বাস্তবে ফিরে এলো রুনা। নিজের টুকরো টুকরো অতীতকে জোড়া লাগিয়ে এক অনাবিল সুখের সন্ধানে কখনোই যাওয়া হয়ে উঠে না ওর।
মেয়ে ফোন করেছে।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রুনা ওর মেয়ে ফোন ধরতে ওর দেরী হচ্ছে দেখে ভ্রু কুচকে এমন এক ভঙ্গীতে রয়েছে...
একা একা হাসতে থাকে। হাসির শব্দে ওর পাশের সীটের যাত্রী ফিরে তাকায়।
একটু বিরক্ত হয়। সেই লোক একটা পেপারব্যাক পড়ছিল। মুখ ঘুরিয়ে আবার পড়ায় মন দেয়।
রুনা হাসি চেপে রেখে ফোন রিসিভ করে।
কেন এতো হাসি?
কিভাবে ওর জীবনে এখনো এতো হাসি রয়ে গেছে ভাবতে ই ওর অবাক লাগে।
:হ্যা, বল মা।
এক মায়ের চিরন্তন ভালোবাসা ওর সাময়িক হতাশাকে দূর করতে মোটেও বেগ পায় না। তবে এটা যেমন অল্পতে চলে যায়, ফিরেও আসে তাড়াতাড়ি।
বারবার ফিরে আসে। চলে ও যায়।
এমনি আসা-যাওয়ার মাঝে জীবন চলে তার নিজস্ব গতিতে।
জীবনের 'ওয়ান-ওয়ে ট্রাকে'- যেখান থেকে পিছনে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই।
তবু ও চলতে হয়... আশায় বুক বেঁধে।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৮২০ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুভেচ্ছা রইলো।
যদি কোন উপায় থাক তো সব মানুষ শুধু শৈশবে ফিরে যেতে চাই ত ।
ধন্যবাদ ভাল লাগল ।
খুব সুন্দর মন্তব্যটির জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা আপনাকে।
একেবারে অপ্রাসঙ্গিকও বলেন নাই। মাসুদ রানার মত থ্রিলার সিরিজ না হলেও; কয়েকজন কালো মনের মানুষ যারা নিজেদেরকে সাদা মনের মানুষে পরিণত করার এক আন্দোলনে নেমেছে- কোনোরকম ঢাকঢোল না বাজিয়ে; এরকম কিছু লোকের পরিচয় পর্ব হল এবারে সিরিজটি। তবে মাসুদ রানার মত খাঁটি দেশপ্রেম রয়েছে এদের সকলের হৃদয়ে। এখানেই রানার সাথে এদের মিল। আর এরা কয়েকজন কিন্তু আপনি, আমি এবং আমাদের সাধারণের প্রতিনিধিত্ব করছে।
ধন্যবাদ সাথে থেকে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
অনেক শুভেচ্ছা।
আপনার লেখার উপর মন্তব্য করার মত যোগ্যতাও আমার নেই.......।
এর সাথে সাগরসম পরিমাণ ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
এর সাথে সাগরসম পরিমাণ ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন